আকতার ফারুক শাহিন : জাদুর চেরাগ যেন মনিরুজ্জামানের হাতে। কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি করলেও বেতন তুলছেন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার স্কেলে। তাও আবার এক যুগেরও বেশি সময় ধরে।
গ্রেড জালিয়াতির মাধ্যমে এভাবে অতিরিক্ত বেতন নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। অবৈধ এ পন্থায় লোপাট হয়েছে সরকারের অর্ধকোটি টাকা। যদিও মনিরুজ্জামান তা স্বীকার করেননি। প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে চাকরি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময়ই তাকে ১১তম গ্রেডে বেতন দেওয়া শুরু হয় বলে দাবি তার।
পরে টাইম স্কেল আর সিলেকশন গ্রেড মিলিয়ে এখন সপ্তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। যদিও এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলছেন তার দপ্তরেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সপ্তম গ্রেডে মনিরুজ্জামান বর্তমানে যে বেতন পাচ্ছেন তা একজন অতিরিক্ত পরিচালকের বেতনের প্রায় সমান। ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হিসাবে কোনোভাবেই এটি পাওয়ার সুযোগ নেই তার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের দপ্তরে কাজ করেন মনিরুজ্জামান। ১৯৯০ সালে কৃষি উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় সাঁট মুদ্রাক্ষরিক পদে শুরু হয় তার চাকরি জীবন। পরে ২০০৪ সালে পদটিকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়।
এর আগে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা কৃষি মন্ত্রণালয় পাঠায় সংস্থাপনে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এ সংক্রান্ত চিঠি অনুযায়ী সেসময় সাঁট মুদ্রাক্ষরিক মনিরুজ্জামানকে কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে রাজস্ব খাতে নেওয়ার পাশাপাশি ১৪তম গ্রেডে তিনি বেতন পাবেন বলে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
পরবর্তী ৬ বছরে সিলেকশন এবং টাইম স্কেল মিলিয়ে ১৩তম গ্রেডে উন্নীত হন তিনি। ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া এক চিঠিতে দেখা যায়, ওই বছর আরেক দফা উন্নীত হয় মনিরুজ্জামানের বেতন গ্রেড। কম্পিউটার প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হওয়ায় ১১তম গ্রেডে উন্নীত হয় তার বেতন।
এ পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও ওই বছর থেকেই হঠাৎ মনিরুজ্জামানের বেতন আসতে শুরু করে ৭ম গ্রেডে। বিষয়টি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে তোলপাড় হলেও ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কাছের মানুষ হওয়ায় মুখ খোলার সাহস পাননি কেউ। বর্তমানে বাড়ি ভাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং যাতায়াত মিলিয়ে ৭২ হাজার টাকার বেশি বেতন পাচ্ছেন তিনি। অথচ চাকরি বিধি অনুযায়ী ১০ম গ্রেডে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতন হওয়ার কথা নয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বেতন গ্রেড উন্নীত হলেও এটি কার্যকর হয়েছে মূলত ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী একজন ৩য় শ্রেণির কর্মচারীর উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মাঝে কম করে হলেও ১০ বছর ব্যবধান থাকতে হয়। সে অনুযায়ী ২০১৯ সালে তিনি একটি উচ্চতর গ্রেড পেতে পারেন। তাতে তার বেতন আসতে পারে ১০ম গ্রেডে।
এর ৬ বছর পর তিনি ২য় বার উচ্চতর গ্রেড পাবেন। সাধারণত একই পদে চাকরি করা কোনো সরকারি কর্মচারী তার পুরো চাকরি জীবনে দু’বারের বেশি উচ্চতর গ্রেড পান না। সেখানে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে মনিরুজ্জামান কী করে ৭ম গ্রেডে বেতন পেতে শুরু করলেন সেটি বিস্ময়কর। সর্বশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসেও তার মোট বেতন এসেছে ৭২ হাজার ৫৩৮ টাকা।
অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত পরিচালক পরিচয় না প্রকাশের শর্তে বলেন, পিআরএলে আসার আগের মাসে আমার বেতন ছিল ৭৪ হাজার টাকার কিছু বেশি। সেখানে ৩য় শ্রেণির একজন কর্মচারী কী করে ৭২ হাজার টাকা বেতন পান সেটা আমার বোধগম্য নয়।
নিশ্চয় এখানে বড় কোনো ঘাপলা আছে। অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত বেতন নেওয়াই কেবল নয়, ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ে একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তারেরও অভিযোগ রয়েছে মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে। অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বদলিসহ নানাভাবে তদবির বাণিজ্য করেও তিনি আয় করেন লাখ লাখ টাকা। এসব অবৈধ আয়ে নগরের অভিজাত বিএম কলেজ এলাকায় গড়েছেন ৫ তলা সুরম্য ভবন।
পরিবহণ ব্যবসাসহ নামে-বেনামে আরও বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে তার। অভিযোগের বিষয়ে মনিরুজ্জামান বলেন, ১৪তম গ্রেড নয়, আমি চাকরিতে যোগদান করেছি ১১তম গ্রেডে। এরপর ৩টি টাইম স্কেল এবং একটি সিলেকশন গ্রেড যুক্ত হওয়ায় তা ৭ম গ্রেডে উন্নীত হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হয়নি।
অর্থ ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুযায়ী আপনাকে ১৪তম গ্রেডভুক্ত করে প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আনা হয়। সেই সংক্রান্ত চিঠি আমাদের কাছে আছে। এছাড়া আপনি সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কিংবা ডিপ্লোমাধারী নন। সেক্ষেত্রে কী করে ১১তম গ্রেডে এলেন জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রস্তাবনায় আমাকে ২০০১ সালে রাজস্ব খাতভুক্ত করা হয়।
তাছাড়া আমার দপ্তরই আমাকে ১১তম গ্রেডে আত্মীকরণ করেছে। এখানে সংস্থাপন কিংবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে কী ছিল বা আছে তা আমার জানা নেই। কৃষি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় প্রস্তাবনা দিলেই তো আর তা কার্যকর হবে না। সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই কেবল তা বাস্তবায়ন হবে।
কেননা সংস্থাপন যেমন রাজস্ব খাতের পদ-পদায়ন নিশ্চিত করে তেমনি বেতন ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই দুই মন্ত্রণালয় তাকে ২০০৪ সালে প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আনার অনুমোদন দিয়েছে এবং তা দেওয়া হয়েছে ১৪তম বেতন গ্রেডে। অর্থ মন্ত্রণালয় তার বেতন ছাড় করেছে ২০০৪ সাল থেকে। তাই ওই বছর থেকেই তার সরকারি চাকরিতে আত্মীকরণের সময় ধরতে হবে।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক হারুন অর রশিদ বলেন, আমি যতদূর জানি মনিরুজ্জামান ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। তিনি যদি ৭ম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন তবে তা বিস্ময়কর হবে। ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক হিসাবে আমি অল্প কিছুদিন বরিশালে দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে সেখানে নতুন অতিরিক্ত পরিচালকের পদায়ন হয়েছে। আমার অল্প কিছুদিনের দায়িত্ব পালনের মধ্যে এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। তাই বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com