ধান-মাছ-নদী-খাল… এই নিয়ে বরিশাল। এতদিন এমনটা বলা হলেও আজকের বরিশাল তার গৌরব অনেকটা হারানোর পথে। কীর্তনখোলা নদীর পাড়ের এই শহরে যেখানে জালের মত ছড়ানো ছিল অসংখ্য খাল। যার বেশিরভাগই এখন দখল-দূষণে পর্যুদস্ত! বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের স্থাপিত নামফলক দেখে আজকাল বুঝতে হয় যে এখানে একসময় বহমান ছিল স্বচ্ছ টলমলে পানির খাল!
গৃহস্থালি বর্জ্য- পয়ঃ বর্জ্য থেকে শুরু করে কল-কারখানার বিষাক্ত ক্যামিক্যাল বর্জ্য এখন সরাসরি ফেলা হচ্ছে বরিশাল শহরের খালগুলোতে। অধিকাংশ কল-কারখানার ইটিপি নেই, অল্প সংখ্যক কারখানার ইটিপি থাকলেও তা সচল নয়। অন্যদিকে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাও মধ্যযুগীয়। যার ফলে প্রতিনিয়ত খালগুলো দূষিত পানিতে ছয়লাব হচ্ছে, যা জোয়ার-ভাটার টানে গিয়ে সরাসরি মিশছে কীর্তনখোলার পানিতে। পাশাপাশি প্রভাবশালী মহলের নানান অপতৎপরতায় বেদখল হয়ে যাচ্ছে খালপাড়ের জমি। একই আগ্রাসন চলছে শহরের অনেক প্রাচীন পুকুর-দিঘী-জলাশয়ের ক্ষেত্রেও।
শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত বরিশাল জেল খাল রক্ষায় ২০১৪ সালের অক্টোবরে দুই সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিটের শুনানি করে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
দুই সপ্তাহের মধ্যে জেল খাল ভরাট/দখল ও ময়লা আবর্জনা ফেলা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে চার সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এ আদেশ ছাড়াও আদালত একটি রুল জারি করেছিলেন। রুলে বরিশালের জেল খাল ভরাট/দখল বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট।
দখল ও দূষণমুক্ত করে বরিশাল শহরের ২২টি খালকে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। খালগুলোকে দখলমুক্ত করা ও প্রতিটি খালের রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌর্ন্দয বৃদ্ধির জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। নগরীর ২২টি খাল চিহ্নিত করে এরই মধ্যে সাইনবোর্ড লাগানো ও উচ্ছেদ অভিযান চলেছে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, এলজিইডি ও এনজিওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়।
শহরের এ খালগুলোর মধ্যে রয়েছে— জেল খাল, সাগরদী খাল, লাকুটিয়া খাল, আমানতগঞ্জ খাল, নাপিতখালী খাল, ভাটার খাল, ভাড়ানী খাল, চাঁদমারী খাল, ভেদুরিয়া খাল, ইছাকাঠী খাল, কলাডেমা খাল, নবগ্রাম খাল, হরিনাফুলিয়া খাল, পুঠিয়া খাল, সাপানিয়া খাল, জাগুয়া খাল, সাগরদী খাল, কাশিপুর খাল, টিয়াখালী খাল, ঝোড়াখালি খাল ও সোলনা খাল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনকার বাস্তবচিত্র যথেষ্ট হতাশাজনক। উন্নতি বলতে শুধু খালপাড়ে স্থাপিত সাইনবোর্ডগুলো, যা শুধু সাক্ষ্য দেয় খালগুলো চিহ্নিত করার। গত দুই দিন এই প্রতিবেদক সরেজমিনে খালগুলো পরিদর্শন করে এর বেশি কিছু উদ্ধার করতে সক্ষম হননি।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে- কীর্তনখোলা বেদখল! দপদপিয়া ফেরি ঘাটের উত্তর পাড়ে প্রভাবশালীদের তত্ত্বাবধানে চলছে কীর্তনখোলা বেদখল করার মহোৎসব! নদী পাড়ের প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা এরই মধ্যে সুকৌশলে দখল করা হয়েছে। নদীতে স্থাপিত ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে আবার নদী ভরটের কাজেই সেই বালু ব্যবহার করা হচ্ছে! নদী বক্ষে পাইলিং করে রীতিমত সীমানা ঠিক করে এক প্রকার ফ্রি স্টাইলে চলছে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ!
হাইকোর্টের এক রায়ে সম্প্রতি বলা হয়েছে- নদীর সর্বোচ্চ জোয়ারের পয়েন্ট থেকে দুই পাড়ে দেড়শ’ ফিট পর্যন্ত নদীর জমি। কিন্তু আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রভাবশালীমহল প্রশাসনের এক প্রকার অসাধু লোকদের সাথে নিয়ে কীর্তনখোলা গিলে খাওয়া শুরু করেছে। এমনিতেই দপদপিয়া সেতুর কারণে কীর্তনখোলার এই পয়েন্টে নাব্যতা হুমকির মুখে। তার সাথে যোগ হয়েছে নদীদস্যুতা! দপদপিয়া সেতুর এক কিলোমিটার থেকে দেড় কিলোমিটার উজানে চলছে এই অবৈধ দখলের বেসাতি।
নদী দখল-দূষণের অভিযোগ। এলাকাবাসী অনেকেই বলেছেন তীব্র বায়ু দূষণের কথা। কারখানা থেকে উদগরিত ছাই এবং ধোঁয়া আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকার বাতাস দূষিত করছে।
টাকা ও পেশিশক্তির জোরে এরা সবকিছুই গ্রাস করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকে চিরতরে নিশ্চুপ করাতে এরা পিছপা হয়না। সঙ্গত কারণেই অনেকে সাংবাদিক দেখে অনেক অভিযোগ করলেও শেষ পর্যন্ত অন দ্য রেকর্ড কেউ কিছু বলার সাহস করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম রূপাতলীর আব্দুল খালেক আকন্দ। সত্তোরাদ্ধ এই প্রৌঢ় কীর্তনখোলার বুকে দাপিয়ে পার করেছেন তাঁর শৈশব-কৈশর-তারুন্য। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন কীর্তনখোলা পাড়ের জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বের কথা। দুর্বৃত্তদের হাতে কত প্রতিবাদি-ভুক্তভোগী মানুষ আহত-নিহত-নির্যাতিত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ জানে না। তিনি শুধু জানেন- যে এই অবৈধ দখলে বাঁধা হয়েছে তাকেই বিদায় নিতে হয়েছে চিরতরে। প্রশাসন পকেটে পুরে চলছে দখলবাজি হরহামেশা।
মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, আইন অনুযায়ী নদীর জায়গা দখল ও ভরাট করা যাবে না। কিন্তু প্রশাসনের সামনেই নদী ভরাট করা হচ্ছে, যা বেআইনি ও অবৈধ। বরিশালের জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা এর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়তই অবৈধভাবে এ ধরনের ভরাটের ঘটনা ঘটছে।বরিশালের কীর্তনখোলা নদী ভরাট করে বাঁধ নির্মাণের ওপর একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্টে জনস্বার্থে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ রিট করেন।
নদী খাল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এনায়েত হোসেন শিপলু বলেন, আগামীতে যে ভয়াবহতা দেখতেছি তা নিয়ে আমরা শংকিত। অচিরেই নদী দখল মুক্ত করতে হবে। প্রশাসন দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে কীর্তনখোলাসহ সবগুলো নদী তার চিরচেনা রূপ হারাবে। শুধু কীর্তনখোলা নদীর দুপার দখল করেছে প্রায় ৪ হাজার ১৯২ জন প্রভাবশালী দখলদার।এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, নদীর জমি দখল হলেও বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তারা বিভিন্ন সময় জরিপ ও দখলদারদের চিহ্নিত করলেও তাদের তালিকা প্রকাশ করেনি। অভিযোগ রয়েছে, তারা দখলদারদের কাছ থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের জেলা সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, প্রশাসন দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে কীর্তনখোলাসহ প্রায় সব কটি নদী তার চিরচেনা রূপ হারাবে।
বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ বারবার দখলদারদের তালিকা করার উদ্যোগ নিলেও এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি।
বরিশাল জেলা প্রশাসক বলেন, বিআইডব্লিউটিএ দখলদারদের তালিকা না দেয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
২০২১ সালে উচ্চ আদালত সিএস মৌজা ম্যাপ ধরে নদীর সীমানা নির্ধারণ করার আদেশ দিলেও এখনও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
নদীগবেষক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্ট্যাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক কারণে আজকের প্রবহমান নদী কয়েক দশক পর তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। তবে নাব্যতা সংকটের শুরুর দিকে যদি নদীগুলোর পরিচর্যা করা হতো, সঠিক সময়ে সঠিক পয়েন্টে ড্রেজিং করা হতো, তাহলে প্রবহমান নদীর আজ এই করুণ পরিণতি হতো না। সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবেই প্রবহমান নদী আজ মরে গেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শতাব্দীব্যাপী ব-দ্বীপ গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই প্রজন্ম না হলেও পরবর্তী প্রজন্ম সুফল পাবে। পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে নদীর নাব্যতা সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করেন তিনি।