কিন্তু যে বাসে তিনি যান সেটিতে ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই। সব আসনই যে কেবল পরিপূর্ণ ছিল তাই নয়, বাসের ইঞ্জিন কভারে পর্যন্ত ছিল যাত্রী। নূর ইসলাম বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার পরও কেন বোঝাই করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে বাস থেকে নেমে যেতে বলে চালক ও তার সহকারী-পোষালে যান না পোষালে নেমে যান, এভাবেই বলে তারা।’
কেবল এই একটি রুট-ই নয়, বরিশালের দুটি বাস টার্মিনাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে যত বাস চলছে তার প্রায় সবগুলোতেই ঘটছে এমন ঘটনা। আসন পূর্ণ করার পর দাঁড় করিয়েও নেওয়া হচ্ছে যাত্রী। কিন্তু ভাড়া নেওয়া হচ্ছে শতকরা ৬০ ভাগ অতিরিক্ত। প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বরঞ্চ প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত এমনকি মারধরের শিকার হওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। ২৮ মে শুক্রবার বরিশাল থেকে মঠবাড়িয়া যাওয়ার উদ্দেশে রুপাতলী টার্মিনাল থেকে পরিবারের চার সদস্যের জন্য বাসের টিকিট করেন টিকিকাটা গ্রামের শামীম সিকদার।
স্বাভাবিক সময়ের ১৬০ টাকার স্থলে প্রতিটি টিকিট কাটা হয় ২৪০ টাকা করে। বাসে ওঠার পর শামীম দেখতে পান ভেতরে কোনো সিট খালি নেই। ইঞ্জিন কভারেও বসে আছে যাত্রী। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও শিশুকন্যাসহ তাদের বলা হয় দাঁড়িয়ে যেতে। প্রতিবাদ করলে বাসের চালক ও সহকারী মিলে বেধড়ক মারধর করে শামীমকে। মারধরের শিকার হন তার বৃদ্ধা মা এবং স্ত্রীও। একপর্যায়ে শামীমের সাত বছর বয়সি শিশুকন্যাকে বাসের জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলা হয় বাইরে। বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ করেও শেষ পর্যন্ত সঠিক বিচার বলতে কিছুই পায়নি ওই পরিবার।
বরিশাল থেকে হিজলা রুটের যাত্রী আনিসা আক্তার বলেন, ‘বরিশালে পড়াশোনা করার সুবাদে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয় বাসে। আগে বরিশাল থেকে হিজলা পর্যন্ত বাস ভাড়া নিত ৭০ টাকা। করোনা শুরু হওয়ার পর অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার শর্তে ১০০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া শুরু করে মালিকরা। প্রথম দিকে দুই আসনে একজন যাত্রী নিলেও এখন তা মানা হচ্ছে না। ১০০ টাকা ভাড়া নেওয়ার পাশাপাশি বোঝাই করে নেওয়া হচ্ছে যাত্রী। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েও যেতে হচ্ছে। এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ছোটখাট ঝামেলা হয় যাত্রীদের সঙ্গে। কিন্তু পরিবহণ শ্রমিকদের একরোখা আর অভদ্র আচরণের কারণে শেষ পর্যন্ত হার মানে সাধারণ মানুষ।’
বাসে অতিরিক্ত যাত্রী আর বেশি ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে কথা হয় এখানে থাকা দুই মালিক সমিতির নেতাদের সাথে। তারা উলটো দোষ দেন যাত্রীদের। বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাশরেক বাবুল বলেন, ‘যাত্রীরাই জোর করে উঠে পড়ে বাসে। অপেক্ষা করার মতো সময় যেন নেই তাদের হাতে। তবে এটা যে সব রুটে হয় তা নয়। এমন বহু রুট রয়েছে যেখানে যাত্রী-ই পাওয়া যায় না। আমরা বেশ কয়েকটি পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়েছি। অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া হয় কিনা তা দেখার পাশাপাশি যারা নিয়ম ভঙ্গ করছে তাদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।’
বরিশাল-পটুয়াখালী মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাওসার হোসেন শিপন বলেন, ‘অনিয়ম যা হয় তা টার্মিনাল থেকে বাস ছেড়ে যাওয়ার পর। কিছু শ্রমিক মাঝপথ থেকে অতিরিক্ত যাত্রী তোলে। প্রমাণসহ এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার পর বেশ কয়েকজনকে শাস্ত দিয়েছি।’
বাসের মতো লঞ্চেও চলছে অতিরিক্ত যাত্রী বহন আর বেশি ভাড়া আদায়। লঞ্চ মালিকরা অবশ্য এক্ষেত্রে অনেক বেশি কৌশলী। করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মানার আড়ালে এরই মধ্যে লঞ্চের ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ঢাকা-বরিশাল রুটে ডেক শ্রেণির ২৫০ টাকার ভাড়া এখন নেওয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা। মালিকরা বলছেন, করোনার জন্য নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়েছে ভাড়া। এটা বহাল থাকবে করোনার পরেও। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি এখনো জারি করেনি সরকার।
অতিরিক্ত যাত্রী বিষয়ে বলতে গেলেই মালিকরা বলেন, লঞ্চে অনেক কম যাত্রী নিচ্ছেন তারা। কিন্তু ঘাটে গিয়ে চোখে পড়ে ভিন্ন দৃশ্য। প্রথম শ্রেণির দুই আসনের কেবিনে একজন করে যাত্রী নেওয়ার কথা থাকলেও কোনো কোনো কেবিনে চার থেকে ৫ জন পর্যন্ত যাত্রী থাকে। মালিকরা আবার কেবিনের অতিরিক্ত যাত্রীদের কাছ থেকে মাথাপিছু আদায় করছেন ডেক শ্রেণির ভাড়া। স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে বেশি যাত্রী পরিবহণ প্রশ্নে লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতাও পালন করছে একটি বিশাল ভূমিকা।
পানিতে নামার আগে লঞ্চের ধারণক্ষমতায় শুরুতেই যে কারচুপি করা হয় তার সুযোগ নিচ্ছেন মালিকরা। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী এমভি পারাবত লঞ্চের অফিসিয়াল ধারণক্ষমতা এক হাজার ২৫ জন। যদিও বিশালাকৃতির এই লঞ্চটিতে তিন হাজার যাত্রী উঠলেও মনে হবে সেটি পরিপূর্ণ হয়নি।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই লঞ্চ যাত্রী নিতে পারবে ৫০০ জনের কিছু বেশি। অথচ ৩০০-এর বেশি যাত্রী যায় পারাবতের কেবিনেই। এরপর তিনটি ডেকে ২০০ যাত্রী গেলে অবশিষ্ট যে জায়গা থাকবে তাতে ফুটবল খেলা যাবে। বাস্তবে সেখানে যাত্রীর ভিড়ে পা ফেলার জায়গাও থাকে না। এই চিত্র কেবল পারাবত নয়, ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী প্রায় সব লঞ্চের।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিআইডব্লিউটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘যাত্রী ধারণক্ষমতার ওপর নির্ভর করে বার্ষিক ট্যাক্স ধরা হয় লঞ্চগুলোর। এজন্য শুরুতেই ধারণক্ষমতা কমিয়ে চলাচলের অনুমোদন নেয় লঞ্চগুলো। অবশ্য সরকারি সেই হিসাবের অর্ধেক যাত্রী নিলে আপনা-আপনি মানা হয়ে যায় স্বাস্থ্যবিধি। কিন্তু সেটুকুও মানছেন না মালিকরা।’ বিষয়টি সম্পর্কে আলাপকালে কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি ও সুন্দরবন লঞ্চ কোম্পানির মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘করোনায় চরম যাত্রী সংকটে চোখে অন্ধকার দেখছি। এ অবস্থায় যদি কেউ বলে যে আমরা অতিরিক্ত যাত্রী নিচ্ছি তবে তা ডাহা মিথ্যা।
তাছাড়া আমরা স্বাভাবিক ভাড়াতেই যাত্রী নিচ্ছি। সরকার বাস মালিকদের ক্ষতি পোষাতে শতকরা ৬০ ভাগ ভাড়া বাড়িয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা করা হয়নি। ভাড়া বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে তা স্বাভাবিক বৃদ্ধি। ২০১৩ সালের পর আর লঞ্চের ভাড়া বাড়েনি। আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভাড়া বাড়িয়েছে।
করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কম যাত্রী নেওয়া সত্ত্বেও আমরা ভাড়ার ক্ষেত্রে যেমন কোনো সুবিধা পাইনি তেমনি প্রণোদনা কিংবা সরকারি কোনো সহায়তাও পাইনি। অথচ এবারে ৪৭ দিন আর গত বছর টানা ৬৬ দিন আমাদের লঞ্চ বন্ধ ছিল। সরকারের উচিত অসহায় লঞ্চ মালিকদের জন্য কিছু করা।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com