আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম :
থানার হাজতখানায় সিসিটিভি ক্যামেরা, তাই নির্যাতনের দৃশ্যপট আড়াল করতে পাশের কক্ষে নিয়ে বেধড়ক পিটুনি। পুলিশি নির্মমতার এক পর্যায়ে লাঠির আঘাত পড়ে তাঁর স্পর্শকাতর অঙ্গে। দু'দিন সেখান থেকে ঝরে রক্ত। পেটাতে পেটাতে পুলিশ সদস্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, 'ওসি স্যারের সঙ্গে আর বেয়াদবি করবি।' তাঁর কোমর থেকে নিচে দুই পায়ে সেই বর্বরতার লালচে তাজা ক্ষত। শরীরের অন্য স্থানেও মারধরের দাগ। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মাত্রা কেমন ভয়াবহ ছিল- কলেজছাত্র মো. মোস্তাকিমের চোখের ভেজা আঙিনা জানান দিচ্ছিল। মায়ের ডায়ালাইসিসের খরচ বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করা মোস্তাকিম এখন দেশজুড়েই আলোচিত। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বেরিয়ে আসে আরও অজানা তথ্য।
ওসির 'চোতরা পাতার গল্প' :চোতরা পাতার ছোঁয়াতেই শরীর বেশম চুলকায়- এ কথা সবার জানা। তবে এই চোতরা পাতার গল্প নতুন করে শোনালেন চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দীন মজুমদার! থানায় নির্যাতনের অভিযোগ আড়াল করতে তিনি চোতরা পাতাকে এখন 'ঢাল' হিসেবে ব্যবহার করছেন।
গত রোববার জামিনে বের হয়ে মোস্তাকিম থানায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তারের পর থানায় নির্যাতনের অভিযোগকে 'নাটক' বলে মন্তব্য করে ফেসবুকে লম্বা স্ট্যাটাস দেন অভিযুক্ত পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম। সেই পোস্টে মোস্তাকিমকে 'শিবিরের সঙ্গে সখ্য' রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, তাঁর শরীরে 'চোতরা পাতা' লাগিয়ে আঘাতের সাজানো দাগ তৈরি করা হয়েছে। ওসির এ কাণ্ডে সমালোচনার ঝড় বইছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে 'নাজিম জিম' নামে এই আইডি থেকে করা পোস্টটি বেশিক্ষণ রাখেননি তিনি। দুপুরের পর থেকে ওসির পোস্টটি আর দেখা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, অতিরিক্ত মহানগর পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) মাহতাব উদ্দীনকে একাধিকবার ফোন করলেও তাঁরা ধরেননি। তবে তদন্ত কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আলী হোসেন বলেন, 'তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তার চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব না।' ওসি কমিটির মুখোমুখি হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, 'কমিটির প্রধান বিষয়গুলো দেখছেন।'
মোস্তাকিম বলেন, 'থানায় পুলিশের নির্মম নির্যাতনের বিচার চাই। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় মা ও পরিবারে সঙ্গে আলাপ করেই মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। মঙ্গলবার চমেক হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছি। ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খাচ্ছি।'
পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদারকে তাঁর সরকারি ও ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। তবে পাঁচলাইশ থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত সাদেকুর রহমান জানান, অসুস্থতাজনিত কারণে ওসি স্যার ছুটিতে আছেন।
মোস্তাকিমের আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসান বলেন, 'পুলিশ কখনও আসামির গায়ে হাত তুলতে পারে না। পুলিশের কাজ আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো। বেআইনিভাবে মোস্তাকিমকে থানায় নির্যাতন করা হয়েছে। তার আলামত মোস্তাকিমের শরীরে রয়েছে। মোস্তাকিমের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সন্তোষজনক না হলে তখন ওসির বিরুদ্ধে মামলা করব।
গুরুতর অভিযোগ ওসির বিরুদ্ধে :আন্দোলনে ধাক্কাধাক্কির সময় ওসির মোবাইল ফোন ফেলে দেন মোস্তাকিম। এর পরই মূলত মোস্তাকিমের ওপর তেতে ওঠেন ওসি নাজিম। তাঁকে গ্রেপ্তার, মামলার আসামি, থানায় নির্যাতন, কারাগারে পাঠানো- সবকিছুই করা হয়। মোস্তাকিম বলেন, 'হাসপাতালের সামনে থেকে থানায় নেওয়ার পর প্রথমে হাজতখানায় রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পর এক পুলিশ সদস্য এসে আলাদা একটি কক্ষে নিয়ে যান। যেখানে আমি ছাড়া আরও কয়েকজন পুলিশ ছিল। প্রথমেই ওরা আমার দাড়ি দেখে জামায়াত-শিবির করি কিনা জানতে চান। আমি বলি না। তাহলে দাড়ি এত বড় কেন? এটা তো শিবিরের দাড়ি। তখন আমি বলি, আমাকে কিছু এনে দেন, আমি দাড়িটা কেটে ফেলি। এটা বলার পরই লাঠি দিয়ে আমাকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। এমনভাবে মারছিল, কোথায় আঘাত লাগছে সেটাও দেখছিলাম না। দুই পা ও অণ্ডকোষে বেশম আঘাত পাই। মারধর করা পুলিশ সদস্যের নেমপেল্গট ছিল না। তিনি ওসির সঙ্গে ছিলেন। সাধারণ পুলিশ সদস্য। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পেটানো হয়।
মোস্তাকিম বলেন, 'নির্যাতনকারী ওই পুলিশ সদস্য এতটাই অমানবিক, তিনি আমার স্পর্শকাতর অঙ্গেও আঘাত করেন। যখন আমি অনেকটা অজ্ঞানের মতো হয়ে যাই, তখন আমাকে আগের হাজতখানায় নিয়ে যান। দু'দিন প্রস্রাব করতে গিয়ে রক্ত যেতে দেখেছি, ব্যথায় কাতর হয়েছি।'
নির্যাতনের অভিযোগকে নাটক দাবি :ওসি নাজিম তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, 'সত্য চিরন্তন, মিথ্যা ক্ষণস্থায়ী...', 'যে ছেলেটি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শুধু আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অফিসে আসে, আমার পা ধরে সালাম করতে চায়, ভেবেছিলাম অনুশোচনা বোধ থেকে হয়তো...। ছেলেটির মাকে নিজেই মা বলে সম্বোধন করলাম, ডায়ালাইসিসের জন্য ছেলে হিসেবে আর্থিক সহযোগিতা করলাম, অথচ সেই ছেলেটিরই এত নাটক। তোমাকে যদি থানা হেফাজতে এতই নির্যাতন করা হয়, আদালতে তো একটিবারও সে কথা বললে না। জামিনে আসার পর একটিবারও কাউকে বললে না, পুলিশ যদি লাঠি দিয়ে পেটায় তার দাগ কি এমন হয়? ছোট বেলায় আমরা গাছের একটা পাতাকে খুব ভয় পেতাম। নোয়াখালীর ভাষায় এটাকে ছোত্তা পাতা (চোতরা পাতা) বলে। যেখানেই লাগবে, চুলকাবে আর লাল বর্ণের হয়ে যাবে। ১০ তারিখে পুলিশি নির্যাতনের আঘাত ১৬ তারিখ পর্যন্ত কীভাবে এত সতেজ থাকে? এখন তো মেডিসিন দিয়েও এসব দাগ বানানো যায়। সবচেয়ে বড় কথা, এই বিষয়টাকে ইস্যু তৈরি করার একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। এই ছেলেটা যদিও ইসলামী ছাত্রসেনার সদস্য, কিন্তু জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তার সখ্য আছে। এর প্রমাণ, তার আশেপাশে যারা তাকে সহযোগিতা করছে, সবাই সরকারবিরোধী উস্কানিদাতা এবং পুলিশবিদ্বেষী। মোট কথা, এখন আর বিষয়টা ডায়ালাইসিস রোগী আর মোস্তাকিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটাকে একটা জাতীয় ইস্যু তৈরি করে কিছু সুবিধাবাদী তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ নিচ্ছে।' পাঁচলাইশের ওসি নাজিম উদ্দীন মজুমদার তাঁর পুরো নাম বাদ দিয়ে 'নাজিম জিম' নামেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন বলে কয়েক পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
তদন্ত কমিটির কাজ শুরু :মোস্তাকিমকে নির্যাতন, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। গত শনিবার এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সোমবার বিষয়টি জানানো হয়। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) মাহতাব উদ্দীনকে প্রধান করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আলী হোসেন ও অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আবদুল খালেককে কমিটির সদস্য করা হয়। সাত দিনের মধ্যে ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।
ওসি নাজিমকে বাঁচাতে ভিপি নাজিম :বিতর্কে জড়ানো ওসি নাজিমের 'ওকালতি' করছেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি নেতা চাকসু ভিপি নাজিম উদ্দিন। তিনি মোস্তাকিমের আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান, সাংবাদিক আলমগীর অপুসহ বিভিন্ন স্তরে ওসি নাজিমকে বাঁচাতে তদবির করছেন। বিএনপি নেতা নাজিম অনুরোধ করে বলেন, 'ওসি নাজিম আমাদের আপন লোক। ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে।' এটি নিয়ে আর কোনো নিউজ কিংবা মামলা না করার জন্য সাংবাদিক ও আইনজীবীকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন ভিপি নাজিম।
মোস্তাকিমের মায়ের হাতে টাকা দিলেন ওসি :মোস্তাকিমের মোবাইল ফোন ফেরত দেবেন বলে থানায় মোস্তাকিম ও তাঁর মাকে ডেকে নেন ওসি নাজিম। তখন মোস্তাকিমের মাকে 'মা' বলে সম্বোধন করেন ওসি। ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝি বলে জানান। মোস্তাকিমকে জড়িয়ে ধরে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন মোস্তাকিমের মাকে ডায়ালাইসিস করানোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন ওসি। বিষয়টি নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি না করার জন্য ওসি অনুরোধ করেন বলে জানান মোস্তাকিম ও তাঁর আইনজীবী।
প্রসঙ্গত, চমেক হাসপাতালে মায়ের ডায়ালাইসিস করাতেন মোস্তাকিম। হঠাৎ ডায়ালাইসিসের ফি বাড়ানোর প্রতিবাদ করেন রোগী ও স্বজনরা। এ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ১০ জানুয়ারি চমেক হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধের এক পর্যায়ে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ বিক্ষোভকারী রোগী ও তাঁদের স্বজনদের ওপর চড়াও হয়। সেখান থেকে মোস্তাকিমকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তাঁর নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ কিডনি রোগীর স্বজনকে আসামি করে মামলা করে। এরপর পাঁচ দিন কারাগারে থাকার পর রোববার জামিনে মুক্ত হন মোস্তাকিম।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com