রুদ্র মিজান, আল-আমিন ও শুভ্র দেব :
তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেড। ক্লাব ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে-বসে উপভোগ করা যায় নদীর সৌন্দর্য। এমনকি ক্লাবের ভেতরের বিশাল রুম থেকেও স্বচ্ছ গ্লাস দিয়ে দেখা যায় মনোরম দৃশ্যপট। দেখা যায় নদীর জল, নৌকা, ওপারের সবুজ প্রকৃতি। বিকালে, রাতে প্রাকৃতিক এই পরিবেশে ঢাকা বোট ক্লাবে জমে আড্ডা। সন্ধ্যা নেমে এলেই একের এক বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে ক্লাবে যান সদস্যরা। আসেন অতিথিরাও। অতিথি হিসেবে থাকেন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নায়িকা, মডেল থেকে শুরু করে শোবিজ জগতের অনেকে।
রাত ১২টার পর ক্লাবের সার্ভিস বন্ধ থাকার কথা থাকলেও বিশেষ ব্যক্তিদের আড্ডার সময়ের ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। এই ক্লাবেই ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে। আহত হয়েছে তার এক সঙ্গী। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেডের নির্বাহী কমিটির বিনোদন ও সংস্কৃতি বিষয়ক সদস্য নাসির ইউ মাহমুদ, ক্লাব সদস্য অমিসহ পাঁচ জনকে। ঘটনার জেরে বোট ক্লাবের কমিটি থেকে নাসির ইউ মাহমুদকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদে।
তিনতলা বিশিষ্ট বিনোদনের জন্য ঢাকা বোট ক্লাবের ঘরে অ্যাংলিং, টেনিস, স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ডস খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। আয়োজন করা হয় নানা ধরনের জলজ ক্রীড়ারও। ক্লাব ঘরের ভেতরে রেস্টুরেন্ট ছাড়াও রয়েছে বার। বার ও ড্যান্সফ্লোরে সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় ব্যস্ততা। ক্লাবটির কার্য নির্বাহী কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন রুবেল আজিজ। এ ছাড়াও সদস্য হিসেবে নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ রয়েছেন ৯ জন।
গত রোববার ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন পরীমনি। পরে রাতে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগের বিস্তারিত জানান। গতকাল এ ঘটনায় সাভার থানায় মামলা করেছেন নায়িকা পরীমনি। ঘটনাটি ঘটে গত ৯ই জুন রাতে। ক্লাবে কর্মরত কেউ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। ধর্ষণচেষ্টা প্রত্যক্ষ না করলেও সে রাতে ক্লাবে বেশ ঝামেলা, হট্টগোল হয়েছিলো বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাদের একজন ক্লাবের সদস্য ও তুরাগ রিক্রেয়েশন ওয়ার্ল্ডের পরিচালক হাবিব রহমান। হাবিব বলেন, ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে আমি ক্লাবের দ্বিতীয় তলার ভেতরে অবস্থান করছিলাম। ভেতরে প্রবেশ করার আগে অনেক নারী পুরুষকে দেখেছি। অনেকের হাতে মদের গ্লাস ছিল। আমি নিজেও অতিরিক্ত মদ পান করায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। রাত ১২টার দিকে কিছুটা স্বাভাবিকবোধ করলে হট্টগোলের আওয়াজ পাই। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভেতরে থেকে বের হয়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ আরও বেশ কয়েকজনকে দেখতে পাই। আমি আসতে আসতে হট্টগোল প্রায় শেষ হয়ে যায়। পরে আর কিছু বলতে পারি না। তিনি বলেন, ঘটনাটি ঘটেছে পাঁচদিন আগে। গত রোববার থেকে এটি ফেসবুকে ঘুরছে। হাবিব জানান, তিন বছর আগে চার লাখ টাকা দিয়ে বোট ক্লাবের সদস্য হয়েছেন তিনি।
এ ঘটনায় গতকাল সাভার থানায় একটি মামলা রেকর্ড ও নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দায়েরকৃত মামলার এজাহারে পরীমনি অভিযোগ করেছেন, ৮ই জুন রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে বাসা থেকে কস্টিউম ডিজাইনার জিমি (৩০), অমি (৪০), ও বনি (২০) সহ দুটি গাড়িযোগে উত্তরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে অমি বলেন, বেড়িবাঁধস্থ ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেডে তার দুই মিনিটের কাজ আছে। অমির কথামতো ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে রাত ১২টা ২০ মিনিটে গাড়ি থামান পরীমনি। কিন্তু বোট ক্লাব বন্ধ থাকায় অমি কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তখন ঢাকা বোট ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ডরা গেট খুলে দিলে অমি ভেতরে যান। তখন অমি পরীমনিসহ অন্যদের অনুরোধ করে ক্লাবের পরিবেশ অনেক সুন্দর, তোমরা নামলে নামতে পারো।
পরীমনি এজাহারে বলেছেন, আমার ছোট বোন বনির প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিলে আমরা ঢাকা বোট ক্লাবে প্রবেশ করে বারের কাছের টয়লেট ব্যবহার করি। টয়লেট হতে বের হতে নাসির উদ্দিন মাহমুদ আমাদেরকে ডেকে বারের ভেতরে বসার অনুরোধ করেন এবং কফি খাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। আমরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে আমিসহ নাসির উদ্দিন মদপান করার জন্য জোর করেন। আমি মদ পান করতে না চাইলে নাসির উদ্দিন জোর করে আমার মুখের মধ্যে মদের বোতল প্রবেশ করিয়ে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এতে আমি সামনের দাঁতে ও ঠোঁটে আঘাত পাই। নাসির আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। আমার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করেন। আমাকে জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। নাসির উত্তেজিত হইয়া টেবিলে রক্ষিত গ্লাস ও মদের বোতল ভাঙচুর করে আমার গায়ে ছুড়ে মারেন। তখন আমার কস্টিউম ডিজাইনার জিমি নাসিরকে বাধা দিতে চাইলে তাকেও মারধর করিয়া নীলাফোলা জখম করেন।
পরীমনি অভিযোগ করেন, তিনি তখন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল দিতে গেলে তার ব্যবহৃত ফোনটি টান মেরে ফেলে দেন নাসির। পুনরায় ফোনটি উঠিয়ে কল দিতে চাইলে আবারো ফোনটি টেনে ফেলে দেন তিনি।
মামলায় পরীমনি বলেন, মামলার দু’নম্বর আসামি অমিসহ অজ্ঞাতনামা চারজন আসামি নাসিরকে ঘটনা ঘটাতে সহায়তা করে। আমি অজ্ঞাতনামা আসামিদের দেখলে শনাক্ত করতে পারবো। তিনি বলেন, অমি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমাকে বোট ক্লাবে নিয়ে যায় এবং অমিসহ অজ্ঞাতনামা চারজন আসামিদের সহায়তায় নাসির উদ্দিন মাহমুদ আমার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে এবং জোরপূর্বক আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। আমার সঙ্গীদের সহায়তায় ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পাই। পরে রাত তিনটার সময় আমি আমার গাড়িতে প্রায় অচেতন অবস্থায় আমার সঙ্গীদের সঙ্গে ফিরে আসি। পরীমনি অভিযোগ করেন, আসামিরা বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে বিভিন্ন প্রকার ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করছে।
পরীমনির মামলার আসামি অভিযুক্ত নাসির ইউ মাহমুদ একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্য। ৩৭ বছর ধরে ডেভেলপার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ১০ বছর ধরে মাহমুদ কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। কুঞ্জ ডেভেলপার্সের আগে মাহমুদ বিল্ডার্স অ্যান্ড এসোসিয়েশনের এমডি ছিলেন। তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), রাজউক, রেলওয়েসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি কাজ করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক নির্বাহী পরিষদের সদস্য। ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের উত্তরা ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি, লায়ন ক্লাবের ঢাকা জোনের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি জাতীয় পার্টির (জাপা) একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য। ২০২০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর জাপার ৯ম কাউন্সিলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়।
বোট ক্লাবের কমিটি থেকে নাসিরকে বহিষ্কার: অভিনেত্রী পরীমনির অভিযোগের পর ঢাকা বোট ক্লাব কর্তৃপক্ষ নাসির ইউ মাহমুদকে কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে বহিষ্কার করেছে। সোমবার বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির এক ভার্চ্যুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কমিটির সভাপতি ড. বেনজির আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় কমিটির আরও আট সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ে ক্লাবের উপদেষ্টা রুবেল আজিজও সভায় অংশ নেন।
ক্লাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরীমনি এবং নাসির ইউ মাহমুদকে কেন্দ্র করে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈঠকটিতে নাসির ইউ মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকী অমি এবং শাহ এস আলমের ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত করারও সিদ্ধান্ত হয়। অভিযোগ তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে বোট ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে।
সভায় বলা হয়, নাসির ইউ মাহমুদ ক্লাবের নিয়ম না মেনে নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিথিকে ক্লাবের ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন। যা ক্লাবের নিয়ম শৃঙ্খলার পরিপন্থি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com