সকালের কুয়াশা তখনও কাটেনি। মাহমুদ জিন্স ও নূরুল ওয়্যারের কারখানাগামী শ্রমিকদের মহাসড়ক পারাপারের দায়িত্বে ছিলেন নিরাপত্তাকর্মী আজাদুল ইসলাম (৩৫)। তাঁর মতো দায়িত্বে ছিলেন আরও দুই সহকর্মী। সবাই লাল নিশান হাতে যানবাহন থামিয়ে শ্রমিকদের পারাপারে সহায়তা করছিলেন।
গাজীপুরের চন্দ্রায় রোববার সকাল পৌনে ৮টার দিকে দক্ষিণ পাশ থেকে ১০ থেকে ১২ শ্রমিক ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেন মহাসড়ক পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ আজাদুল খেয়াল করেন, ঢাকাগামী পাথরবোঝাই একটি ট্রাক দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। নিশান উঁচিয়ে চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তাঁর ওপর উঠে যায় ট্রাকটি। চাপা দেয় আরও তিন নারী শ্রমিককে।
ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান আজাদুল। অন্যদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নেওয়া হয় হাসপাতালে। প্রত্যক্ষদর্শী আজাদের সহকর্মী হুমায়ুন কবীর বর্ণনা দেন মর্মান্তিক এ মৃত্যুর। হুমায়ুন বলেন, ওই সময় লাল নিশান নিয়ে যদি ট্রাকের সামনে না দাঁড়াতেন আজাদ, তাহলে প্রাণ যেত অন্তত ১০ থেকে ১২ শ্রমিকের। তাঁদের বাঁচাতে তিনি নিজের জীবন দিয়ে গেলেন। দৃশ্যটি বারবার ভেসে উঠছে তাঁর চোখে।
দুর্ঘটনায় সহকর্মী হারানোর সংবাদ কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তাঁরা নেমে আসেন সড়কে। ভাঙচুর করেন অনেক যানবাহন। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা পাথরবোঝাই ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেন তাঁরা। এ সময় তাঁরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশ অবরোধ করেন, যা চলে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। যানজট ছড়িয়ে পড়ে চন্দ্রা থেকে গাজীপুর বাইপাস সড়কের সফিপুর, কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের জিরানী ও টাঙ্গাইলের গোড়াই পর্যন্ত। দুই পাশে আটকা পড়ে অনেক যানবাহন।
মাহমুদ জিনস কারখানার শ্রমিক রবিউল ইসলাম, ঝুমা, নাসরিন আক্তার, রহিমা বেগমসহ কয়েকজন বলেন, প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁদের সহকর্মী নিহত হচ্ছেন। চন্দ্রার ওই এলাকায় পদচারী সেতু নির্মাণের দাবি তাঁদের।
সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে আশে পুলিশের নানা ইউনিট, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতারা। তাঁরা নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা ও পদচারী সেতু স্থাপনে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তখন অবরোধ উঠিয়ে নেন শ্রমিকরা। স্বাভাবিক হয় যানবাহন চলাচল।
নিহত আজাদুল ইসলামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার গোয়ালপাড়া গ্রামে। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবা বাবর আলীর মৃত্যুর পর মা আছিয়া বেগমের দেখাশোনা তিনিই করতেন। পাঁচ-ছয় বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। থাকতেন চন্দ্রার ডাইনকিনি এলাকায় একটি ভাড়া কক্ষে।
আজাদের বড় ভাই আইয়ুব হোসেন বলেন, 'আমার ভাই দীর্ঘ ছয়-সাত বছর এ কারখানায় নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি করত। প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেয়ে মায়ের খরচ পাঠাত।'
মাহমুদ জিনস কারখানার ডিজিএম রফিকুল ইসলাম বলেন, কারখানার পক্ষ থেকে আজাদুলের মরদেহ গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পরিবারকে তাঁর সব পাওয়া বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
গোবিন্দগঞ্জ প্রতিনিধি এনামুল হক জানিয়েছেন, আজাদুলের মরদেহ গোয়ালপাড়ার বাড়িতে পৌঁছলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন মা আছিয়া বেগম। বারবার আকাশের দিকে হাত তুলে বিলাপ করতে থাকেন। ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার নিষ্ম্ফল মোনাজাত ছুঁয়ে যায় গ্রামবাসীকেও।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com