শিশু জন্মের পর রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতির প্রথম পদক্ষেপ হলো জন্মনিবন্ধন। জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে শিশু নাগরিক স্বীকৃতিও পায়। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদেও শিশুর জন্মগ্রহণের পর জন্মনিবন্ধনের কথা বলা হয়েছে। সনদ প্রদান প্রক্রিয়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই নানা ধরনের ভোগান্তির কথা শোনা যাচ্ছে। শুরুতে এ প্রক্রিয়া এখনকার মতো জটিল ছিল না। এ উপমহাদেশে ১৮৭৩ সালে প্রথম জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন প্রণীত হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় জন্মনিবন্ধন শুরু হয়। সরকার ২০০৪ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন করে ও ২০০৬ সলে থেকে তা কার্যকর হয়। এ আইনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-লিঙ্গ নির্বিশেষে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি মৃত্যুরও ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুসনদ সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়। ১৬টি কাজের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। এগুলো হলো- পাসপোর্ট ইস্যু, বিয়ে নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, আমদানি বা রপ্তানি বা উভয় লাইসেন্সত, গ্যাস-পানি-টেলিফোন-বিদ্যুৎ সংযোগ, ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিআইএন), ঠিকাদারি লাইসেন্স, বাড়ির নকশা অনুমোদন, গাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি।

২০১০ সালের জুন মাস পর্যন্ত নিবন্ধন সনদ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হতো। প্রথমদিকে ম্যানুয়ালি অর্থাৎ রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে হাতে লেখা সনদ দেওয়া হতো। তখন জন্মসনদ নম্বরের প্রথমে জন্ম সালের শেষ দুটি অঙ্ক থাকত। সনদ নম্বরের ডিজিট ছিল ১৫। কিন্তু সনদের নিচে স্পষ্ট করে লেখা বিবরণ (প্রথম চার অঙ্ক ব্যক্তির জন্ম সাল, পরবর্তী সাত অঙ্ক এরিয়া কোড ও শেষ ছয় অঙ্ক ধারা ক্রমিক) অনুযায়ী সনদ নম্বরের ডিজিট হওয়ার কথা ১৭। এ ভুল সিস্টেমের। ২০১০ সাল থেকে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। অনলাইনে এন্ট্রির সময় সনদ নম্বরের প্রথমে জন্ম সালের চার অঙ্ক ব্যবহার শুরু হয়। এতে নিবন্ধন নম্বর দাঁড়ায় ১৭ ডিজিটবিশিষ্ট। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ২০১৭ সালেও কিছু অনলাইন নিবন্ধনকৃত সনদে জন্ম সালের শেষ দুই অঙ্ক ব্যবহার করে ১৫ ডিজিটের সনদ প্রদান করা হয়েছে। কোনো সনদে ১৭ ডিজিট আবার কোনো সনদে ১৫ ডিজিট। বর্তমানে ১৭ ডিজিটের নিবন্ধন নম্বর চাওয়া হচ্ছে। ১৫ ডিজিটের নিবন্ধন নম্বর ১৭ ডিজিট করতে গিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ১৫ ডিজিটের সনদ নম্বরের প্রথমে জন্ম সালের চার অঙ্কের প্রথম দুই অঙ্ক (যেমন, জন্ম সাল ১৯৮৪-এর ১৯) বসালে সনদ নম্বরের শেষের ছয় ডিজিট পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ পুরোনো সনদ নম্বর আর ঠিক থাকে না। কারও কারও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রথমে ১৩ ডিজিটের ছিল, পরে ১৭ ডিজিট করা হয় জন্ম সালের চার অঙ্ক ১৩ ডিজিটের সামনে বসিয়ে। কিন্তু নম্বরের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পূর্বে যারা বিভিন্ন কাজে ১৫ ডিজিটের জন্মসনদ ব্যবহার করেছেন; বর্তমানে ১৭ ডিজিটের সনদ ব্যবহার করলে ঝামেলায় যে পড়বেন, তা সহজেই অনুমেয়। কারণ, একজনের নিবন্ধন নম্বর দুটি হতে পারে না।

পূর্বে সনদ দেওয়া হতো বাংলায়। কেউ চাইলে ইংরেজিতেও নিতে পারতেন। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বরের গেজেটে বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষায় সনদ প্রদানের নিয়ম থাকলেও প্রয়োজনীয় কাজে আবশ্যক না হওয়ায় অনেকেই উভয় ভাষায় সনদ গ্রহণ করেননি। ২০২১ সালে নানা কাজে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সনদ সংযুক্তকরণ আবশ্যক হওয়ায় মানুষ তা সংগ্রহ করছে। আগে যারা শুধু বাংলা ভাষায় সনদ নিয়েছিলেন; ইংরেজিতে কোনো তথ্য দেননি তারা বর্তমানে ইংরেজি ভাষায় সনদ নিতে হলে সার্ভারে অপশন দেখায় 'সংশোধন'। ব্যক্তি যেখানে ইংরেজিতে কোনো তথ্যই দেননি, সেখানে 'সংশোধন' দেখাবে কেন? সংশোধনের ফি দিতে হচ্ছে এবং সনদে 'সংশোধিত' লেখা থাকছে। আর একটি জরুরি কথা। ব্যক্তি যদি আবেদনে কোনো ভুল না করেন আর সনদে যদি ভুল ছাপা হয়, তাহলে এটি সংশোধনের জন্য ব্যক্তিকে কেন সংশোধন ফি দিতে হবে?

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি তৈরি, কভিড টিকা গ্রহণের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় সনদ তৈরির জন্য নিবন্ধক কার্যালয়ে অনেকেই যোগাযোগ করছেন। ওদিকে নতুন নিয়মে শিক্ষার্থীদের জন্মসনদের আবেদন করতে হলে তাদের বাবা-মায়েরও জন্মসনদ সংগ্রহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনেক অভিভাবক দেখছেন, তাদের আগে নেওয়া জন্মসনদ এখন আর সরকারি সার্ভারে প্রদর্শন করছে না। সরকার গত বছর আগস্ট মাসে সংশোধিত জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন-২০২১ প্রণয়ন করে। তখন আরেকটি সার্ভার চালু করে। এ সময় ২০১২ সালের আগে যারা জন্মনিবন্ধন করেছিলেন; নতুন সার্ভারে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে অন্তত ৭ কোটি জন্মনিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। নতুন সার্ভারে ম্যানুয়ালি নিবন্ধনের কিংবা পুরোনো সার্ভারের তথ্য আপলোড করার দায়িত্ব কি নিবন্ধনকারীর? যদি এই দায়িত্ব নিবন্ধনকারীর না হয়ে থাকে তাহলে দ্রুত এর সমাধান বের করা জরুরি। দেশে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা আছে। ভুয়া জন্মসনদ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তাই আর কোনো রোহিঙ্গা যাতে ভুয়া জন্মসনদ নিতে না পারে, সে ব্যাপারে সংশ্নিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

সনজিৎ নারায়ণ চৌধুরী :শিক্ষক ও গবেষক