নিত্যপণ্য বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি ৮.৩%। এপ্রিলে যা ছিল ৬.২৩%
এ বছরের মে মাসের মূল্যস্ফীতি বিগত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ মূল্যস্ফীতি তালিকার শীর্ষে আছে খাদ্যপণ্য। আর শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। ফলে গরিব মানুষের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। খাদ্য কিনতেই তাদের আয়ের সিংহভাগ খরচ করতে হচ্ছে। যা তাদের আরও দরিদ্র অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে রবিবার (১৯ জুন)। তারা বলছে, মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭.৪২%-এ পৌঁছেছে। এই হার গত আট বছরে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৪৮%।
এ ঘটনাকে “মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন” বলা হচ্ছে। মে মাসের আগের চার-পাঁচ মাস এটা ৬%-এর কাছাকাছি ছিল। নিত্যপণ্য বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি ৮.৩%। এপ্রিলে যা ছিল ৬.২৩%।
বিবিএস-এর হিসেবে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১০-১১ অর্থ বছরে ১০.৯১%। মে মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৭.৪২% হলেও, গ্রামে এই হার ৭.৯৪% আর শহরে ৬.৪৯%।
কেন এই পরিস্থিতি, গ্রামে কেন বেশি?
সেন্টার ফর পলিসি ডয়ালগের (সিপিডি) বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি আর তার সাথে ডলারের সাথে যে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে তার প্রভাব এখানে দেখা যাচ্ছে। আর স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যেরও দাম বেড়েছে।”
তার মতে, “বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেও দাম বেড়েছে। এটা আমদানি ও উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত। বাজারে নানা ধরনের কারসাজি, সিন্ডিকেট, মজুতদারি এগুলো ঘটেছে। এখানে নজরদারির অভাব ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “সাধারণ মানুষ প্রধানত যে ভোগ্যপণ্যগুলো কেনেন তার মূল্যস্ফীতি গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি। প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বা স্থির আয়ের যারা আছেন তারা যেসব পণ্য বেশি কেনেন তার দাম বেশি বেড়েছে। ফলে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।”
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন মনে করেন, “আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বেশি হারে বেড়েছে। এর প্রধান কারণ এই সরকারের উদ্যোগগুলো ব্যবসায়ীবান্ধব, জনবান্ধব নয়। বাজারে চাল, তেলসহ অনেক পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এইসব সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
দরিদ্র মানুষ আরও চাপে পড়বে
২০১৬ সালে বিবিএস-এর খানা জরিপে দেখা যায় দেশের মানুষ গড়ে তাদের আয়ের ৪৭.৭% খাদ্যের পেছনে ব্যয় করেন। ওই জরিপের তথ্যই বলে দেয় যে মানুষের আয় যত কম খাদ্যের পেছনে সেই মানুষের মোট আয়ের আনুপাতিক ব্যয় তত বেশি। জরিপে মোট ১২টি ইনকাম গ্রুপ দেখানো হয়।
তাতে বলা হয়, সর্বনিম্ন আয়ের পাঁচ ভাগ মানুষ খাবারের পেছনে তাদের আয়ের ৬২.৫% ব্যয় করেন। আর আয়ের নিম্নতম নয়টি গ্রুপ তাদের আয়ের গড়ে ৫৫ ভাগের বেশি খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে। আর সর্বোচ্চ আয়ের পাঁচ ভাগ মানুষ খাদ্যের পিছনে ব্যয় করে তাদের আয়ের ৩৩.৭%।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বাংলাদেশ একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এখন যা পরিস্থিতি তাতে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা না হলেও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে সংকট আরও বাড়বে।”
কোনো পণ্যেই স্বস্তি নেই। ছবিটি কাপ্তান বাজার থেকে তোলা/ ফোকাস বাংলা
তার কথা, “যারা নিম্নআয়ের তাদের তো খাদ্য কেনার সামর্থই কম। এখন দেখা যাবে আয়ের ৯০%-ই খাদ্য কিনতে ব্যয় করতে হবে। তাতেও সে পর্যাপ্ত খাদ্য পাবে না। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত খাদ্য ব্যয় বাড়াতে পারবে। এর আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব আছে নন ফুড আইটেমের ওপর। মানুষ ফ্রিজ, টেলিভিশনের মতো আরও অনেক জিনিস কেনা কমিয়ে দিচ্ছে। যার প্রভাব এই ধরনের শিল্পে এরইমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এটাও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
এস এম নাজের হোসেন বলেন, “দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ তার আয়ের ৭০% খাদ্য কিনতে ব্যয় করে। এখন যেটা হচ্ছে এই ব্যয় বাড়ানোর মতো অর্থ তাদের হাতে না থাকায় তারা খাবার কেনা কমিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। খাবার কম খাচ্ছে। এটা দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা সংকটের মুখে পড়বে। অপুষ্টিতে ভুগবেন তারা।”
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “যদি আয় না বাড়ে তাহলে তাহলে সাধারণ বা কম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে। তারা আরও চাপে পড়বে। খাবার কিনতেই তাদের প্রায় সব আয় চলে যাবে।”
এখন তাই প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি দরকার। সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচির ব্যাপ্তি ও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। নিম্নতম মজুরি কাঠামো রিভাইজ করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হবে। আর আয় বাড়ানোর কর্মসূচি নিতে হবে। এখন বন্যার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সুরক্ষা কর্মসূচি এবং খাদ্য সহায়তা বন্যাদুর্গত এলাকায় বাড়াতে হবে।”
আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি যেগুলো আছে সেগুলো ঠিকঠাক মতো যাতে চলে তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাড়তি করার জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই। আর কর্মসংস্থান যে তেমন বাড়ানো যাবে তাও নয়। ফলে আপাতত সংকটের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে।”
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: nomanibsl@gmail.com মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com